রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে মাঠে ফিরতে চাইছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের উদ্যোগ নেয় দলটি, কিন্তু সফল হয়নি। তখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিনটিকে জাতীয় শোক দিবসের মর্যাদা থেকে বাতিল করেনি সরকার। এর পর থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি দেয়নি আওয়ামী লীগ।
আজ রবিবার শহীদ নূর হোসেন দিবস পালনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে দলটি। রাজধানীর জিরো পয়েন্টে শহীদ নূর হোসেন চত্বরে অগণতান্ত্রিক শক্তির অপসারণ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে এই কর্মসূচি সফল করার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে একই স্থানে নতুন কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আজ রবিবার দুপুর ১২টায় গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে গণজমায়েত ও ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ মঞ্চের আয়োজন করবে সংগঠনটি।
গতকাল শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই কর্মসূচির একটি পোস্টার শেয়ার করে এ তথ্য জানানো হয়। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বলে পোস্টারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থা মোকাবেলা করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আওয়ামী লীগকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকেও সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে বিক্ষোভ পালনের বার্তা দেওয়া হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল করতে বলা হয়েছে।
পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর বাধা পেরোতে আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘দলবদ্ধভাবে নয়, একা একা আসবেন; বিভিন্ন পথ পরিবর্তন করে গুলিস্তান পৌঁছাবেন; সঙ্গে থাকা মোবাইলে কোনো ছবি, কোনো ওয়ালপেপার রাখবেন না, যাতে আপনাকে আওয়ামী লীগ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে; যদি কোনো বাধা আসে, অবশ্যই কোনো রকম ভাঙচুর বা নাশকতার ফাঁদে পা দেবেন না; আওয়ামী লীগ সরকারি সম্পদ, দেশের মানুষের সম্পদ ধ্বংসের রাজনীতি করে না এবং সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য প্রচারণা চালাবেন।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও শহীদ নূর হোসেন দিবস পালন করবে আওয়ামী লীগ।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেউ বাধা দিতে পারে না। আর বাধা এলে তা মোকাবেলা করেই বিক্ষোভ করা হবে। এই অবৈধ, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আওয়াজ তোলা হবে।
কর্মসূচি সফল করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, ‘সরকার শুরু থেকেই আমাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনমানুষের দল। দেশের ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া এই দলকে এত সহজে অস্তিত্বহীন করা যাবে না। হামলা-মামলার ভয় উপেক্ষা করে নেতাকর্মীদের মাঠে নামার আহ্বান করছি। আজ আমরা শহীদ নূর হোসেনকে স্মরণ করব। নূর হোসেনের বুকে যেদিন গুলি লেগেছিল সেদিন ১৪৪ ধারা দিয়ে রেখেছিল তখনকার স্বৈরাচারী সরকার।’
এদিকে আওয়ামী লীগকে মাঠে কোনো ধরনের সুযোগ দিতে চায় না অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলমের কথা থেকে এমন বার্তা পরিষ্কার। গতকাল শনিবার শফিকুল আলম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন যে রূপে (কারেন্ট ফর্ম) আছে, তাতে এটি একটি ফ্যাসিবাদী দল। এই ফ্যাসিবাদী দলটিকে বাংলাদেশে বিক্ষোভ করার অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গণহত্যাকারী এবং স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নির্দেশে কেউ সমাবেশ, জমায়েত এবং মিছিল করার চেষ্টা করলে তাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর অবস্থানের মুখোমুখি হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সহিংসতা কিংবা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি লঙ্ঘনের কোনো চেষ্টা মেনে নেবে না।’
অনেকটা একই সুরে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘গণহত্যাকারী/নিষিদ্ধ সংগঠনের কেউ কর্মসূচি করার চেষ্টা করলে কঠোর অবস্থান নেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বৈঠক :
শহীদ নূর হোসেনের স্মরণে ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আজ রবিবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর জিরো পয়েন্টে শহীদ নূর হোসেন চত্বরে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে গতকাল সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বৈঠক চলে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগের ডাকা বিক্ষোভের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই আন্দোলন দমনের কৌশল নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ। এ সময় সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানা গেছে। তবে আজ সকাল থেকে গুলিস্তান এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থার আয়োজন করা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। গতকাল আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের এক পোস্টে এ বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি একটি পোস্টারের ছবিও শেয়ার করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ করলে ‘টিকিট টু হ্যাভেন’, বাকিদের জীবন হেল :
নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগকে ‘ফ্যাসিবাদের মূল ফুটসোলজার’ বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’ আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেন, “অনেকে ছাত্রলীগ কেন ব্যান হলো, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চান। আপনি দেখেন, কী মহত্ একটা আন্দোলন এই ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা শুরু করল। বাংলাদেশের এ রকম মহত্ আন্দোলন কয়টা হয়েছে? যদি পেছনে ফিরে তাকান, নব্বইয়ের যে আন্দোলন ওইটাও মহত্ ছিল। কিন্তু এবারের যে আন্দোলন, এটার যে ব্যাপ্তি, এটা মানুষকে যে নাড়া দেওয়া এবং তারা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গেল পুরো পৃথিবীর কাছে! তো এই আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল ছাত্রলীগ। তারা ছিল ফ্যাসিবাদের ‘মূল ফুটসোলজার’।”
বিগত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “তাদের (ছাত্রলীগ) চাকরি হয়েছে পুলিশে, তাদের চাকরি হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থায়। পুরো জাতিকে তারা জিম্মি করে রেখেছিল। আপনি ছাত্রলীগ করবেন, এটা আপনার ‘টিকিট টু হ্যাভেন’। বাকিদের জীবন ‘হেল’। পুলিশের লোক যখন ভেরিফিকেশনে আসছে, তাদের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ছেলেরাই বলছে, ‘এই ছেলেটা বিএনপি করে, তাকে চাকরি দেবেন না’।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের পেছনেও ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করে প্রেসসচিব বলেন, ‘আন্দোলনে পুলিশ যে এত গাঁটছড়া বেঁধে নামল এবং আমাদের ছোটো ভাইদের ওপর নির্বিচারে গুলি মারল। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন এদের ব্যাকগ্রাউন্ড ছাত্রলীগ।’
খুলনা গেজেট/এইচ